• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

পাহাড়ের বুকে সড়ক, যোগাযোগের নতুন মাইলফলক

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ১১ মার্চ ২০২৪  

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে নির্মাণ হচ্ছে এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক। এটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তিন পার্বত্য জেলার সীমান্ত সুরক্ষায় নির্মিত হচ্ছে সড়কটি। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটার সড়কের ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বদলে যাচ্ছে পার্বত্য যোগাযোগ ব্যবস্থা। গতি আসবে জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে।

অসাধ্য সাধন করে তিন জেলার শেষ প্রান্তে দুর্গম পাহাড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই সড়ক। যার ব্যাপ্তি ও গন্তব্য রামগড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত। এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়কটি নির্মিত হচ্ছে তিন ধাপে। প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটারের মধ্যে এখন দৃশ্যমান ২২০ কিলোমিটার। আগামী মে মাসে দৃশ্যমান হবে পুরো সড়ক।

অসাধ্য বলার কারণ সমতলে যত সহজে শ্রমিক এবং নির্মাণসামগ্রী পাওয়া যায়; পাহাড়ে তত সহজ নয়। সমতলে একটি ইটের দাম ৯ টাকা, পাহাড়ি পথ বেয়ে সেটিকে সীমান্তের কাছাকাছি নিতে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় তিন-চার গুণ বেশি। একইভাবে সড়ক তৈরির সব উপকরণ তো বটেই, নির্মাণশ্রমিক পেতেও বেগ পেতে হয় দুর্গম পাহাড়ে। সবমিলিয়ে বলা যায়, এক অসাধ্য সাধন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

রাঙামাটির বিলাইছড়ির ফারুয়া কিবাং জুরাছড়ির দুমদুম্যার কথা ধরা যাক। সেখানে জেলা শহর থেকে পৌঁছাতে লাগতো দুই-তিন দিন। এখন সড়কটি ব্যবহার করে দুই ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। অথচ বছর খানেক আগেও এমন ছিল না। সড়কটি শুধু এলাকার মানুষের চলাচল কিংবা জীবনযাত্রা সহজ করেনি, সুরক্ষিত করেছে পার্বত্য অঞ্চলের বিশাল সীমান্তকে। ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেছে এই যাতায়াত ব্যবস্থা। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে খুলবে নতুন দুয়ার। বাড়ছে পর্যটকদের বিচরণ। সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে বসতি ও দোকান। স্থানীয়দের বেড়েছে কর্মসংস্থান। যা এখানকার মানুষের কাছে এখনও স্বপ্নের মতো। এমন উন্নয়নে খুশি দুর্গম অঞ্চলের মানুষজন।

আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে গেছে জানিয়ে বিলাইছড়ি উপজেলার রোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নন্দলাল চাকমা চাকমা বলেন, ‘সড়ক নির্মাণ হওয়ার আগে নদীপথে তক্তানালা হয়ে জেলা শহরে চিকিৎসার জন্য যেতে হতো। কোনও কোন গ্রাম থেকে জেলা শহরে যেতে এক-দুই দিন লাগতো। এখন কয়েক ঘণ্টায় সীমান্ত সড়ক দিয়ে যেতে পারছি। আমাদের জীবনযাত্রা ও যাতায়াত ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে এই সড়ক।’

সড়ক না থাকায় আমাদের অনেক ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করতে হতো উল্লেখ করে বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া এলাকার বাসিন্দা শান্তি লাল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আগে পণ্য পরিবহন কঠিন ছিল। নিজেদের জন্য খাবার উৎপাদন করতাম। অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন হলে জেলা শহরে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। সড়ক হওয়ায় এখন ক্রেতারা গ্রামে এসেই আমাদের পণ্য কিনে নিয়ে যান। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি আমরা।’

বিলাইছড়ির সাইচল গ্রামের বাসিন্দা ক্লিন্টন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আগে গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে তাকে কাঁধে করে নিয়ে পায়ে হেঁটে জেলা শহরে যেতে একদিন লাগতো। অনেক সময় রোগী পথেই মারা যেতো। সড়ক হয়ে যাওয়ায় এখন যানবাহন ও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। অথবা সড়কের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকগুলোর চালকের কাছে সহযোগিতা চাইলে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দেন। এই সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হলে আমাদের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে গ্রামের মানুষজন সহজে জেলা শহরে যেতে পারবে।’

সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের দেওয়া তথ্যমতে, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হবে এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৩১৭ কিলোমিটার মধ্যে ২২০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মে মাসে শেষ হবে প্রথম ধাপের কাজ। দ্বিতীয় ধাপে ৩৫০ কিলোমিটার কাজের প্রস্তুতি চলছে। যা শেষ করতে পাঁচ বছর লাগবে। সড়কটি নির্মাণ হলে বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে খাগড়াছড়ির রামগড় যাওয়া সহজ হবে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে ১৭, ২০ ও অ্যাডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮৬১ কোটি টাকা।

এই সড়কের কাজ করা ছিল আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এমনটি জানালেন প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল ভূঁইয়া মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘কারণ এই এলাকায় শ্রমিক পাওয়া, পণ্য সঠিক সময়ে নিয়ে আসা, পাহাড়ি সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎপাত, এখানকার প্রকৃতি, মাটি সবকিছু মিলে কাজ করা কঠিন ছিল। সব চ্যালেঞ্জ জয় করে দুর্বার গতিতে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা। চলতি বর্ষা মৌসুমের আগেই প্রথম ধাপের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যাবে। আগামী মে মাসে এই ধাপের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে।’

এই অসাধ্য সাধন সেনাবাহিনী ছাড়া সম্ভব হতো না জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘সড়কের প্রথম ধাপের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, আগামী মে মাসে কাজ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এরপর সবার জন্য খুলে দেওয়া হবে। তারপরই দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেবো। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হবে।’

ঝালকাঠি আজকাল