• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

ছাব্বিশে পাতাল রেল যুগে বাংলাদেশ

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

রাজধানীর যানজট প্রবণ অন্যতম সড়ক হলো বিমানবন্দর থেকে রামপুরা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত। সরু রাস্তা, অতিরিক্ত যানবাহনসহ নানা কারণে এই পথ পাড়ি দিতে কত সময় লাগতে পারে—তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এমন বাস্তবতায় নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে এই পথে পাতাল রেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর মধ্য দিয়ে পাতাল রেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি-১) প্রকল্পের আওতায় এই রেল নির্মাণ হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাসে বিমানবন্দর-কমলাপুর যেতে গড়ে সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা। পাতাল রেল চালু হলে সময় লাগবে মাত্র ২৪ মিনিট। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১টি স্টেশন বিশিষ্ট ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো পাতালে নির্মাণকাজের সময় আশপাশের ভবন ও টানেল দেবে যাওয়া, ট্রাফিক সমস্যা, মাটি ব্যবস্থাপনাসহ বর্ষায় পাতালে পানি বেড়ে যাওয়া।

প্রকল্প নির্মাণে চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, পাতাল রেল নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছু সমস্যা দেখা যায়। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হওয়ায় এ সমস্যাগুলো আরও প্রকট হতে পারে।

তিনি বলেন, মাটির নিচে কাজ করার সময় আশপাশের ভবনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। টানেলও দেবে যেতে পারে। টাইট করিডরের কারণে পাতাল থেকে মাটি ওঠানোর সময় ট্রাফিক সমস্যা বাড়বে। এসব বিষয় সামাল দিতে আগে থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বর্ষায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক বেশি ওপরে থাকে। এতেও ভীত দুর্বল হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, সব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই এমআরটি-১ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি যথাসময়ে শেষ হবে। কাজ শেষে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যাত্রীদের যুগ-যুগের যানজটের ভোগান্তি শেষ হবে।

কর্মকর্তারা জানান, মূলত ১২টি প্যাকেজে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ১১টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন। তিনটি প্যাকেজের টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এটিও উত্তরা-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী মেট্রোরেলের আদলে বিদ্যুতে চলবে। নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূর থেকেই।

এই লাইনে প্রথমে আট কোচ বিশিষ্ট ২৫ সেট ট্রেন দিয়ে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে। ভবিষ্যতে ৩৬ সেট ট্রেন চালানো হবে। প্রতিটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮৮ জন যাত্রী পরিবহন করা যাবে। বিমানবন্দর-কমলাপুর রুট হবে পাতাল ও পূর্বাচল অংশ হবে উড়াল।

এমআরটি লাইন-১-এ ১২টি ভূ-গর্ভস্থ স্টেশনে বিরতিসহ ট্রেনে করে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। অন্যদিকে ৯টি স্টেশনে বিরতিসহ নতুন বাজার-পূর্বাচল টার্মিনাল যেতে সময় লাগবে ২০ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। এ ছাড়া নতুন বাজার ইন্টারচেঞ্জের মাধ্যমে ১৬টি স্টেশনে বিরতিসহ পূর্বাচল থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। পাতাল অংশে ঘণ্টায় ট্রেন চলবে ৯০ কিলোমিটার ও উড়াল অংশে চলবে শত কিলোমিটার গতিতে।

এই পাতাল রেল নির্মাণে ব্যয় হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। জাপানি ঋণ ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে মেটানো হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

দ্বিতীয় মেট্রোরেল হবে উড়াল ও পাতাল পথের সমন্বয়ে। এর মধ্যে বিমানবন্দর-কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার পাতাল রেলে থাকছে ১২টি স্টেশন। এগুলো হচ্ছে বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, নদ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, আফতাব নগর, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর। আর পূর্বাচল রুটের নতুন বাজার ও নদ্দা দুটি স্টেশন বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে পাতালে হবে। এরপর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলের নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথ। এ রুটে ৯টি স্টেশন হলো নতুন বাজার, নদ্দা, জোয়ারসাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল পূর্ব, পূর্বাচল টার্মিনাল।

উল্লেখ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ডিএমটিসিএলের অধীনে ছয়টি মেট্রোরেল (এমআরটি) নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এতে রাজধানীজুড়ে ১২৯ দশমিক ৯০১ কিলোমিটার মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে এলিভেটেড লাইন হবে ৬৮ দশমিক ৭২৯ কিলোমিটার এবং ভূ-গর্ভস্থ লাইন (পাতাল পথ) হবে ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার। রাজধানীজুড়ে থাকবে ১০৫টি স্টেশন। এর মধ্যে ৫২টি থাকবে ওপরে এবং ৫৩টি পাতালে।

এমআরটি-১-এ প্ল্যাটফর্মে ওঠানামা করতে উভয়পথের স্টেশনে থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি)। নতুন বাজার স্টেশনে এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের সঙ্গে আন্তঃলাইন সংযোগ থাকবে। নদ্দা ও নতুন বাজার স্টেশন আন্তঃসংযোগ রুট ব্যবহার করে বিমানবন্দর রুট থেকে পূর্বাচলে যাওয়া যাবে।

এমআরটি-১-এর প্রকল্প পরিচালক আবুল কাসেম ভূঁইয়া বলেন, যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পের একটি এটি। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে প্রতিদিন আট লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। জীবন যাত্রায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ হবে। যানজট বহুলাংশে হ্রাস পাবে। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। প্রকল্পের তিনটি অংশের টেন্ডার প্রক্রিয়া বেশ এগিয়েছে। সিপি-০২ অংশের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক।

প্রকল্পের নথি বলছে, বিমানবন্দর রুটে সর্বনিম্ন ২ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড ও পূর্বাচল রুটে সর্বনিম্ন ৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ড ট্রেন থামবে। এমআরটি-১ পরিচালনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হাতিরঝিল এবং পূর্বাচল এলাকায় দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন থাকবে। এ ছাড়া প্রতিটি স্টেশন ও ডিপোতে বেকআপ পাওয়ার সিস্টেম হিসেবে ডিজেল জেনারেটর সেট থাকবে।

পাতাল রেল নির্মাণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মাটি ব্যবস্থাপনা। ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, অত্যাধুনিক উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে নির্মাণ হবে এমআরটি-১ প্রকল্প। সড়কের অর্ধেকাংশ ব্যবহার করে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ২০০ মিটার দীর্ঘ স্টেশন নির্মাণের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করতে চার মাস সময় লাগতে পারে। এরপর নির্মাণাধীন স্টেশন অংশ প্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু স্টিল পাত দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। এ পাতের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

জানা গেছে, পাতালে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন স্থানান্তরের যাবতীয় নকশা চূড়ান্ত ও যৌথ জরিপের কাজ শেষ। এ ছাড়া বিমানবন্দর স্টেশন, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ স্টেশন এবং খিলক্ষেত স্টেশন এলাকায় পরিষেবা স্থানান্তর-সংক্রান্ত যাবতীয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।

মাটি ব্যবস্থাপনা: উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে প্রতিটি পাতাল স্টেশন নির্মাণকালে উত্তোলনকৃত মাটি হবে গড়ে প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার ঘনমিটার। প্রতি কিলোমিটার টানেল নির্মাণের সময় উত্তোলনকৃত মাটি হবে গড়ে প্রায় ৪৬ হাজার ঘনমিটার। এ বিপুল পরিমাণ মাটি প্রথমে সরকারি মহাসড়ক, সড়ক, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য এমআরটি লাইনগুলোর ডিপোর ভূমি উন্নয়নেও এ মাটি ব্যবহার করা হবে। এর পরও মাটি অবশিষ্ট থাকলে উন্মুক্ত দরপত্রে বিক্রি করা হবে। কমলাপুর-রামপুরা পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা কম থাকায় ওপর-নিচ পদ্ধতিতে মাটির ওপর থেকে কম-বেশি ৩০ মিটার গভীরতায় টানেল নির্মাণ করা হবে।

গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়ন-সংক্রান্ত প্যাকেজ সিপি-১-এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৩২ ভাগ। ডিপোর ভূমি অধিগ্রহণ শেষ। ডিপো এক্সেস করিডোর, বাড্ডা রিসিভিং সাবস্টেশন এবং নদ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, আফতাব নগর, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর পাতাল মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর ভূমি অধিগ্রহণ ও বিভাগীয় হস্তান্তর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

ঝালকাঠি আজকাল