• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

মানাং গ্রাম: পর্বতের পাদদেশে এক টুকরো সুখ

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০২৩  

পাহাড়ের গা বেয়ে পাথুরে উঁচুনীচু রাস্তায় চলে গাড়ি এসে থামে সমতল মতো একটা জায়গায়। কিছুটা উপরে হেঁটে উঠতে হবে লজ পর্যন্ত। লজের গেট দিয়ে ঢুকতেই উল্টোদিকের দৃশ্য দেখে আমি হতবাক! হিমালয়ের পর্বত, তুষার ঢাকা চূড়া আর অসংখ্য ঝর্ণা দেখতে দেখতে আসার পথেই বুঝেছি মূল গন্তব্য মানাং গ্রামে অপেক্ষা করছে চমৎকার কিছু, কিন্তু তা যে এত বেশি চমৎকার আর বিস্ময়কর হবে বুঝিনি। লজের উঠানমতো জায়গা থেকেই উল্টোদিকে দেখা যাচ্ছে পুরো অন্নপূর্ণা পর্বতশ্রেণি আর গঙ্গাপূর্ণা পর্বতের চূড়া, গঙ্গাপূর্ণা হিমবাহ।
প্রথমবার পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতগুলো দেখার বিস্ময় নিয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছাই নেপালের অন্নপুর্ণা সংরক্ষিত অঞ্চলের মানাং গ্রামে। উপত্যকার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে মারসিয়ান্দি নদী, তার পাশেই অল্প কিছু বসতি নিয়ে গড়ে ওঠা এই ছোট্ট গ্রাম। সূর্যাস্তের পরপরই তাপমাত্রা নেমে গেল মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে। লজে পৌঁছেই তাই আগে খুঁজি একটু গরম জায়গা। এখানকার সবগুলো লজেই একটা কমন ডাইনিং স্পেস থাকে যেখানে আগুন জ্বেলে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা থাকে, সেখানে গিয়ে বসি। সেখানেই সেরে নিই রাতের খাবার।

পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ি ট্রেকিংয়ে। লজ থেকে বের হয়ে মারসিয়ান্দি নদী পার হয়ে এক ঘণ্টা পাহাড়ে উঠলেই চোংকর ভিউ পয়েন্ট। এই ভিউ পয়েন্ট থেকে পুরো মানাং উপত্যকা, গ্রাম, আশপাশের অনেকগুলো পর্বতচূড়া আর গঙ্গাপূর্ণা হিমবাহ দেখা যায়।  শীতকাল বলে এদিকে পর্যটক ছিল খুবই কম। প্রায় এক ঘণ্টা একা হাঁটার পর দেখি নীচ থেকে আরও দুজন পর্যটক আসছে এই ভিউ পয়েন্টের দিকে। তাদের জন্য অপেক্ষা করি। কাছাকাছি এলে কিছুক্ষণ কথা বলে তাদের দেশ আর ঘোরাঘুরির গল্প জানলাম, জানালাম আমার দেশের কথা। নেইস আর এলসা নামের এই দুই ডাচ পর্যটকের সাথে বেশ একটা আড্ডা দিয়ে আবার এগোলাম নিজের পথে।


চোংকর ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে পেলাম এক চায়ের দোকান। কিন্তু পর্যটক তেমন নেই বলে দোকান বন্ধ। তাই না থেমে উঠতে থাকি আরও। এদিক-সেদিক অনেকগুলো ছোট পাথরের কুটির, যেখানে থাকে রাখালরা। এখান থেকে আরও একটু আগাতেই দেখি পাইন বনের ভূমি জুড়ে জমে আছে সাদা, শক্ত বরফ। এরপর যতই এগোতে থাকি, বরফও বাড়তে থাকে। তবে পিচ্ছিল শক্ত বরফে সাধারণ ট্রেকিং জুতা পরে হাঁটা বিপজ্জনক। তাই আবার নামার পথ ধরি।

নামার পথে পরিচয় হলো এক বেলজিয়ান পর্যটক জুলিয়ানের সাথে। জানতে পারলাম পরের দিন সে আইস লেক পর্যন্ত ট্রেক করবে। আমারও একই পরিকল্পনা থাকায় ঠিক করলাম দুজন একসাথে যাবে আইস লেকে। পাইন বন, দৈত্যাকার পাহাড় আর অপরূপ সুন্দর উপত্যকা দেখতে দেখতে দুপুরে ফিরে এলাম লজে।

বিকেলে সেই ডাচ পর্যটক নেইসের সাথে বের হলাম মানাং গ্রামটা ঘুরে দেখতে। মানাং এর মাঝ দিয়ে একটা মূল রাস্তা পাথরের তৈরি। রাস্তার দুপাশ দিয়েই সবগুলো টুরিস্ট লজ। একটা সিনেমা হলও খুঁজে পেলাম সেখানে। মূল রাস্তাটা থেকে অনেকগুলো সরু গলি উপরে উঠেছে বা নিচে নেমেছে। এসব দিকেই বসতি স্থানীয়দের। এই গ্রামের সবগুলো বাড়ি তৈরি পাথর এবং কাঠ দিয়ে। বেশিরভাগ বাড়িই তিনতলা। শীতকালে যখন সবকিছু তুষারে ঢেকে যায় তখন বাড়ির নিচতলায় ঠাঁই হয় গবাদি পশু চমরি গাঁই আর ছাগলের পালের। দ্বিতীয় তলায় থাকে মানুষ আর তৃতীয় তলায় গবাদি পশুর জন্য জমা করা খাবার।


সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করলে তুষার ঢাকা পর্বতচূড়ার রং হয়ে যায় আগুন-রাঙা। সাথে দ্রুত কমতে শুরু করে তাপমাত্রা। শীত বাড়তে থাকায় আমরা ফিরে যাই লজে। ফেরার পথে দেখি উপত্যকার সমতল অংশ থেকে রাখালরা ফিরছে শত শত ছাগল, চমরি গাঁই আর ঘোড়ার পাল নিয়ে। এদের গলায় বাধা ধাতব ঘণ্টার মিষ্টি শব্দ সন্ধ্যা-নামা পরিবেশে অদ্ভুত এক মূর্ছনা তৈরি করে।

আমার লজের ডাইনিং স্পেসে গিয়ে বসি সন্ধ্যার পর। নানা দেশের ট্রেকারদের সাথে দারুণ এক আড্ডা জমে সেখানে। রাতের খাওয়া শেষে সবাই নিজেদের রুমে চলে যাওয়ার পর আমি একা থাকায় লজের মালিক আর স্টাফরা তাদের সাথে আবার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় আমাকে। পুরোপুরি স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেয়ার আশায় আরেক দফা খেতে বসি তাদের সাথে। বাকহুইটের গুড়ার তৈরি প্যানকেকের মতো এক ধরনের রুটির সাথে চমরি গাইয়ের মাংস আর মরিচ ভর্তা, চমরি গাইয়ের মাখন দিয়ে তিব্বতীয় বাটার-চা আর নেপালী মিষ্টি ওয়াইন ছিল তাদের রাতের খাবারে।

পরের সকালে বেলজিয়ান বন্ধু জুলিয়ানের সাথে পরিকল্পনামতো বের হয়ে পড়ি আইস লেক ট্রেকে যাওয়ার জন্য। মানাং থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। পথে পড়বে পাশের গ্রাম ভ্রাকা।

আইস লেক ট্রেকের প্রায় অর্ধেক ওঠার পর হাই অ্যাল্টিচিউডের জন্য কিছুটা মাথাব্যথা শুরু হয় আমার। এ অবস্থায় আবার নিচে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিই। নিচে নেমে ঘুরে দেখি ভ্রাকা গ্রাম। পাহাড়ের গায়ে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পাথুরে বাড়িঘর। সবচেয়ে উপরে ভ্রাকা মনাস্টারি। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাই সেখানে। কয়েকশত বছরের পুরোনো এই মনাস্টারি, ফলে বৌদ্ধ ধর্মের নানা উপাদানে সমৃদ্ধ এটি। এখানকার চমৎকার স্থাপত্য, কাঠখোদাই করা সূক্ষ্ণ নকশা, প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ এ পথের পর্যটকদের ভালোই আকর্ষণ করে। এসব ঘুরে দেখে আবার ফিরে যাই মানাং গ্রামে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিই লজের ছাদে, বিশাল অন্নপূর্ণার সামনে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে। সূর্য ডোবার সময়ে বরফ-ঢাকা পর্বতচূড়ার রং যেভাবে বদলাতে থাকে সে দৃশ্য অপূর্ব!

রাতের খাবার খেয়ে  চলে যাই জুলিয়ানের লজে। সেখানে একসাথে ফুটবল ম্যাচ দেখার দাওয়াত ছিল আগে থেকেই। খেলা দেখা শেষে আবার ফিরে যাই আমার লজে। পরদিন সকালেই বেসিসাহার যেতে হবে। সেখান থেকে কাঠমান্ডু— নতুন কোনো অভিজ্ঞতা আর অন্যরকম সৌন্দর্যের খোঁজে। তবে মানাং গ্রামে হিমালয়ের যে মোহনীয় রূপ আর তিব্বতীয় আতিথেয়তা পেয়েছি তা হিমালায়ের অন্য কোনো গ্রামে আবার টেনে নিয়ে যাবে আমাকে।

ঝালকাঠি আজকাল