• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

খেজুরের রস খাওয়া বিপদ!

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহেদ (৩৯) হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তি হওয়ার আগে সাধারণ জ্বর ভেবে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমে না। গত ১৯ জানুয়ারি শাহেদ ঢামেকের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে এক দিন থাকার পর পরীক্ষা শেষে জানা যায়, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে শাহেদের শরীরে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়।

সারা দেশই নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। চলতি বছর এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে ১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আক্রান্তদের মধ্যে সাত জনেরই মৃত্যু হয়েছে, যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিপাহ মূলত ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ। এই সংক্রমণের কোনও লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। আবার জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বিভ্রান্তি ইত্যাদি হতে পারে। এক বা দুই দিনের মধ্যে রোগী অচেতন হয়ে পড়তে পারেন। রোগ সেরে যাওয়ার পর মস্তিষ্কে সংক্রমণ ও খিঁচুনি ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। ভাইরাসে সংক্রমিত পশু ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যেমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগের উপসর্গ থেকে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা যায়। বাদুড়ের কাছ থেকে দূরে থেকে এবং অপরিশুদ্ধ খেজুর রস পান না করে এই রোগের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ ব্যক্তি মারা যায়। দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। গত ২২ বছরে দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩২৬ জন, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৩১ জনের। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১০ জন আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। আগের বছর ২০২২ সালে আক্রান্ত হয় তিন জন। মারা যায় দুজন। এর আগে ২০২১ সালে আক্রান্ত দুজন বেঁচে আছেন। তবে আগের বছর ২০২০ সালে আক্রান্ত সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনই মারা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে— উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। বিশেষ করে মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, মাদারীপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে ইতোমধ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, কয়েকটি জেলায় এখন পর্যন্ত রোগী পাওয়া গেলেও সব জেলাই ঝুঁকিপূর্ণ।

ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কেউ যদি বেঁচেও যান, তার নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আমরা যদি শুধু কাঁচা খেজুরের রস খাওয়াটা বন্ধ করে দিতে পারি, তাহলেই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারি। সতর্কতা অবলম্বন করে রস সংগ্রহ করলেও তাতেও ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ, বাদুড়ের লালা এবং প্রস্রাব থেকে ভাইরাসটি রসের মধ্যে আসে। অর্থাৎ কোনও অবস্থাতেই খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া যাবে না।’

আইইডিসিআর’র একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক জেলায় আক্রান্ত বাদুড় রয়েছে। বিভিন্ন জেলায় মানুষ যদি বেশি খেজুরের রস খায়, তাহলে বড় আউটব্রেকের ঝুঁকি থাকে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত নিপাহ কেস পাওয়া যায়। সে কারণে এখনও মৌসুম আছে। খেজুরের রস যতদিন থাকে ততদিন ঝুঁকি থাকবেই।

প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘মানুষ না জেনে খাচ্ছে। এটা তো অনেক বড় বিপদ। খেজুরের কাঁচা রসে বাদুড়ের লালা, মূত্র, মল লেগে থাকে। যারা খাচ্ছে তাদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে। এই বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘খেজুরের গুড়, রসের পায়েস বানিয়ে খাওয়া যাবে। ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রস ফুটালে যেই স্বাদ থাকার কথা সেটা থাকবে না। আগে বাদুড় তো খেজুরের রসে মুখ দিতো না। বন জঙ্গল উজাড় হয়ে তাদের খাবার হারিয়ে গেছে। খাবারের সন্ধানেই তারা রসে মুখ দিচ্ছে, ২০-৩০ বছর আগে থেকে।’

খেজুরের রস খাওয়া বিপদ!
জানা যায়, এর আগে ২০১৫ সালে দেশে নিপাহ ভাইরাসে ১৫ জন আক্রান্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে মারা যায় ১১ জন। তারপরের বছরগুলোতে নিপাহ রোগীর সংখ্যা ২-৮-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশের ৩২টি জেলার মানুষ নিপাহ ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাই হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০টি আইসোলেশন বেড ও ১৫টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে তিন জন রোগী এসেছিলেন হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে, তার মধ্যে একজন মারা গেছেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘দুই জনের টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। আর একজন মারা গেছেন। তবে তার টেস্ট রেজাল্ট এখনও আমরা পাইনি। তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কিনা এখনও  নিশ্চিত না।’

 
ঝালকাঠি আজকাল