• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

যমুনার পানিপ্রবাহ উপহার দেবে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০১৯  

ঢাকাবাসীকে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা উপহার দেওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কখনো ড্রেজিং, কখনো হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে। এরপরও বুড়িগঙ্গার পানি নিয়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। পানির রং কালচে আকার ধারণ করে ছড়াচ্ছে পচা দুর্গন্ধ। বুড়িগঙ্গার পাড় দিয়ে চলাচল করাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, শীতকালে এর পানি থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়ায়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রোগজীবাণু। দীর্ঘদিন পানি আটকে থাকায় ক্রমেই এর রং কালো হয়ে পড়ছে।

অথচ বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদী ঢাকার ব্যবসা, পরিবহন ও কৃষিতে অসামান্য অবদান রেখে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামনে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক, যমুনার পানিপ্রবাহ ছাড়া নগরবাসীকে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। বুড়িগঙ্গার পানি দূষণমুক্ত ও নাব্যতা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য পানিপ্রবাহ ২৪৫ কিউমিক (CUMEC) থেকে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করতে হবে। এই ব্যবস্থা কাযর্করণে যমুনার প্রধান উৎসমুখের অবস্থান পরিবর্তন অথবা বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা বহুমুখী সেতু) উজানে নতুন উৎসমুখ থেকে পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে পানির প্রবাহ বৃদ্ধিসহ শিল্প ও বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এই প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করেছে এসএ কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।গত মে মাসে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের ওপর নিবিড় পরিবীক্ষণ করে খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমইডি। জুন-২০১৮ পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খসড়া প্রতিবেদনে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গার জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরে সরকারের একমাত্র প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদন তৈরির সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট স্থানগুলো ঘুরে দেখেন আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ।

কারখানার আবর্জনা এসে জমছে বুড়িগঙ্গায়। ছবি: সংগৃহীত

খসড়া প্রতিবেদনে আইএমইডি সূত্র জানায়, যমুনা থেকে বুড়িগঙ্গার দূরত্ব মোট ১৬২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ধলেশ্বরী দুই, পুংলী ৬১ দশমিক ৫০, বংশাই ২০ দশমিক ৫০ ও তুরাগ নদীর দৈর্ঘ্য ৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এসব নদীর অফটেকের উৎসমুখের স্থানটি ভাটিমুখী যমুনার প্রবাহের সঙ্গে সমন্বয় করে সামান্য পরিবর্তন করা অথবা অবস্থানের স্থানান্তর করে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, চক্রাকার নৌপথ ও বুড়িগঙ্গার পানি সহনীয় মাত্রায় দূষণমুক্ত করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে তিন কিলোমিটার ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর বর্তমান উৎসমুখের অবস্থানটিও পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে দেখা যায়, উৎসমুখটি বিগত বর্ষায় যমুনা নদীবাহিত পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। এটি খনন করলে ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গায় যমুনা নদীর পানি প্রবাহ সম্ভব। যমুনা নদীর প্রবাহের সঙ্গে নিউ ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখের অবস্থান অসঙ্গতিপূর্ণ, প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য আরও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়া প্রয়োজন। তাই, যমুনা নদীর প্রবাহের সঙ্গে সমন্বয় করে নিউ ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখের স্থান আবারও যাচাই করা দরকার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেডিমেন্ট বেসিন, ইনটেক চ্যানেল ও সেডিমেন্ট বেসিনের বাইরে বছরে গড়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৫ ঘনমিটার সেডিমেন্ট জমা হবে। জমা সিল্টের ব্যবস্থাপনা জরুরি। ভাটিতে যমুনা নদীর বাম তীরের কাছে ডুবোচর ড্রেজিং করে নাব্যতা পুনরুদ্ধার করা জরুরি।

এই প্রসঙ্গে আইএমইডির উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান  বলেন, দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। এর ধারাবাহিকতায় কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সব প্রতিবেদনে একটা বিষয় বারবার সামনে এসেছে, ঢাকাবাসীকে দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা উপহার দিতে হলে যমুনার পানিপ্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। সবার স্ট্যাডি রিপোর্টেই বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা তথ্যগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।

তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত না করে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনী করে এর কাজ সমাপ্ত করা দরকার। পুংলীর ভাঙন কবলিত স্থানগুলোতে নদীর তীর সংরক্ষণ, নদী প্রশস্ত করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, নদী ও সেডিমেন্ট বেসিনের রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ইত্যাদি কাজ দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ ও নাব্যতা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রকল্পের প্রধান উৎসমুখে পানিপ্রবাহ আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে। কয়েক দশক ধরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানিপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভবে কমে গেছে।

যমুনার পানিপ্রবাহ পেলে দূষণমুক্ত হবে বুড়িগঙ্গা। ছবি: সংগৃহীত

যেখানে-সেখানে নৌযান নোঙ্গর, নদীর তীর দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে জলপথ সরু হয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলো থেকে নোংরা তরলের সঙ্গে বিষাক্ত রাসায়নিকের ক্রমাগত নিঃসরণ এবং নদী ও খালগুলোতে পলিথিনসহ নানাবিধ মানববর্জ্য নিক্ষেপের ফলে এগুলোর তলদেশ ভরাট হচ্ছে।

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় দেখা গেছে, ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখে যমুনা নদী থেকে পানি প্রবেশ করার পথ প্রতিনিয়ত বালি ও পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে, নতুন নতুন চর সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নের পর শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদী থেকে ধলেশ্বরী হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবাহ শুরু হয়। কিন্তু, পরবর্তীকালে তা আবারও ভরাট হয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলোর পরিধি, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে, বুড়িগঙ্গায় পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। পলি ভরাটের কারণে শুষ্ক মৌসুমের উৎস নদী যমুনার সঙ্গে নদীবলয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পানিপ্রবাহ কমেছে। যমুনা থেকে পানির প্রবাহ কমায় ফিডার নদীগুলো শুকনো মৌসুমে প্রায় নাব্যশূন্য থাকে। পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট টেকসই নাব্যতা বজায় রাখার অন্যতম প্রধান বাধা।

২০১০ সালের এপ্রিলে মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পের মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯৪৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি প্রথম সংশোধন করে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মাহমুদুল ইসলাম  বলেন, আইএমইডি যেভাবে চাইবে, সেভাবে আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবো। প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত করার জন্য। সুতরাং, বুড়িগঙ্গায় যমুনা নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করেই দূষণমুক্ত করা হবে। এর জন্য প্রকল্পের আওতায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

 

ঝালকাঠি আজকাল