• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

মৃত্যুর পূর্বেই হোক পরকালের প্রস্তুতি

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ১৬ নভেম্বর ২০২০  

প্রতিটি মানুষকে মরতে হবে। এটা যতটা সুনিশ্চিত এবং সর্বসম্মত, পৃথিবীতে এরচেয়ে সুনিশ্চিত ও সর্বসম্মত দ্বিতীয় কোনো বিষয় নেই। এই কথা শুধু মুসলমানই না, বরং প্রতিটি মানুষই বিশ্বাস করে।

নিজের ওপর শাস্তি প্রয়োগ কর:

তওবা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের নফসকে কিছু শাস্তিও দাও। নিজের নফসকে বলো, তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ। তাই এখন তোমাকে আট রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে। সকালবেলা অঙ্গীকার করার সময়েই এ শাস্তি নির্ধারণ করে নিও। রাতে শোয়ার সময় নফসকে বলো, তুমি নিজে সামান্য আরাম-আয়েশের জন্য এবং কিছু মজা পাওয়ার জন্য আমাকে অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়েছ, তাই এখন তোমাকে সামান্য শাস্তি পেতে হবে। আজকে তোমার শাস্তি হলো শোয়ার পূর্বে তুমি আট রাকাত নফল নামাজ আদায় কর। নামাজ না পড়ে বিছানায় যেতে পারবে না।

শাস্তি উপযুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ হোক:

হজরত থানবি রহ. বলেন, এমন শাস্তি ধার্য কর, যা নফসকে কিছুটা কষ্ট দেয়। কষ্ট বেশি হলে, বিগড়ে যেতে পারে। আবার এত কম যাতে না হয় যে, নফস কষ্টই অনুভব করে না।

কিছু হিম্মত রাখতে হবে:

যাহোক, যদি নফসকে সংশোধন করতে হয় তা হলে হাত-পাকে কিছুটা নড়াচড়া করতে হবে। কিছুটা কষ্ট সহ্য করতে হবে। কিছুটা হিম্মত রাখতে হবে এবং এর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। শুধু বসে বসে তো নফসকে সংশোধন করা যাবে না। তাই এটা স্থির কর যে, যখনি নফস ভুল পথে যাবে তখনি আট রাকাত নফল নামাজ পড়ব। যখন নফস বুঝবে, আট রাকাত নামাজ পড়ার নতুন মসিবত কাঁধে চেপেছে তখন পরদিন থেকে সে তোমাকে গুনাহ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে, যাতে আট রাকাত নফল নামাজ থেকে জান বাঁচাতে পারে। এভাবে ধীরে ধীরে নফস ইনশাআলাহ! সোজা পথে চলে আসবে।

এই চারটি কাজ কর:

ইমাম গাযালি রহ. এর উপদেশের সারকথা হলো, চারটি কাজ কর-

(১) সকালবেলা ‘মুশারাতা’ অর্থাৎ অঙ্গীকার করা।
(২) প্রতিটি আমল বা কাজের সময় ‘মুরাকাবা’ অর্থাৎ নেগরানি করা।
(৩) রাতে শোয়ার পূর্বে ‘মুহাসাবা’ অর্থাৎ সারাদিনের কাজের হিসেব নেয়া।
(৪) যদি অঙ্গীকার রক্ষা না হয় তা হলে নফসকে শোয়ার পূর্বে ‘মুয়াকাবা’ বা শাস্তি দেয়া।

হজরত মুয়াবিয়া রাদি. এর একটি ঘটনা:

হজরত থানবি রহ. লিখেন, হজরত মুয়াবিয়া রাদি. প্রত্যহ তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠতেন। একদিন তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে পারেননি। অনুতাপ ও অনুশোচনায় সারাদিন কাঁদতে থাকেন এবং তওবা-ইসতেগফার করেন। পরের রাতে যখন তাহজ্জুদের সময় হয়েছে, এক ব্যক্তি এসে তাকে তাহাজ্জুদের জন্য জাগিয়ে দিল। তিনি জাগ্রত হয়ে দেখলেন, জাগ্রতকারী একজন অপরিচিত ব্যক্তি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? লোকটি বলল, আমি ইবলিস, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, যদি তুমি ইবলিস হও তা হলে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য জাগানোতে তোমার ফায়েদা কি? ইবলিস বলল, ব্যস, আপনি উঠুন এবং তাহাজ্জুদ পড়ুন। হজরত মুয়াবিয়া রাদি. বলেন, তুমি তো তাহাজ্জুদ থেকে বিরত রাখ, কেন তুমি জাগালে? উত্তরে ইবলিস বলল, আসল কথা হলো, গতরাতে আমি আপনাকে তাহাজ্জুদের সময় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি, এতে আপনার তাহাজ্জুদ ছুটে গেছে কিন্তু সারাদিন আপনি তাহাজ্জুদ ছুটে যাওয়ার কারণে যে পরিমাণ কেঁদেছেন, যে পরিমাণ তওবা ও ইসতেগফার করেছেন, এর ফলে আপনার মর্যাদা যত বেড়েছে তাহাজ্জুদ পড়ার দ্বারা এত বৃদ্ধি পেত না। তাই তাহাজ্জুদ পড়ে নেয়াই ভালো ছিল। এ জন্য আজকে আমি নিজেই তাহাজ্জুদের জন্য জাগাতে এসেছি, যাতে আপনার মর্যাদা আরো বেড়ে না যায়।

অনুশোচনা ও তাওবার মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়:

যদি মানুষ বিগত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে লজ্জিত হয় এবং ভবিষ্যতে তা না করার প্রতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় তা হলে আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে উক্ত বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাকে অনেক ঊর্ধ্বে  তুলে নেয়। হজরত ডা. আবদুল হাই রহ. বলতেন, যখন কোনো বান্দা ভুল করার পর আলাহর দিকে রুজু করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বলেন, তোমার থেকে যে ভুল হয়েছে এটি তোমাকে আমার রহমত ও ক্ষমার পাত্র বানিয়ে দিয়েছে এবং তোমার এ ভুলও তোমার জন্য উপকারী হয়েছে।

হাদিস শরিফে আছে, যখন ইদুল ফিতরের দিন আসে, আল্লাহ তায়ালা স্বীয় ইজ্জত ও প্রতাপের কসম করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, আজকে আমার বান্দারা এখানে একত্রিত হয়ে আমার দেয়া বিধান পালন করছে এবং আমাকে ডাকছে, আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছে এবং স্বীয় কাঙ্খিত বস্তু প্রার্থনা করছে। আমার ইজ্জত ও প্রতাপের কসম, আমি অবশ্যই আজ তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের গুনাহগুলোকে নেকীতে বদলে দেব।

এখন প্রশ্ন হয়, গুনাহগুলো কীভাবে নেকিতে বদলে যাবে?

এর উত্তর হলো, যখন অজ্ঞতা বা গাফলতির কারণে মানুষ থেকে গুনাহ প্রকাশ পায় এবং এরপর সে অনুতপ্ত ও অনুশোচনা নিয়ে আল্লাহর দিকে রুজু করে এবং আল্লাহকে ডাকে যে, হে আল্লাহ, অজ্ঞতা ও গাফেলতির কারণে গুনাহ হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করুন। তখন আল্লাহ তায়ালা তার অনুতাপ ও অনুশোচনার কারণে শুধু তার গুনাহই মাফ করেন না বরং তার বদৌলতে তার মর্যাদাও বৃদ্ধি করেন। এভাবে তার গুনাহও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হয়। কোরআনুল কারিম এ সম্পর্কেই বলেছে,

فَأُولَٰئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ

আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহগুলোকে নেকীতে বদলে দেবেন। (সূরা: ফোরকার, আয়াত: ৭০)।

হজরত বাবা নাজম আহসান রহ. হজরত থানবি রহ. এর খলিফা এবং উঁচু স্তরের একজন বুজুর্গ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্বভাবকবি। তার কবিতাগুলো আমার খুবই পছন্দের। আমি মাঝে মাঝেই তা আবৃত্তি করি। তার একটি পঙ্ক্তি হলো,

دولتیں مل گئیں ہیں آہوں کی
ایسی تیسی مرے گناہوں کی

আলাহ তায়ালা যখন আমাদেরকে গুনাহর ওপর অনুতাপ, অনুশোচনা, অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটির শক্তি দান করেছেন আর আমরা দোয়াও করি যে, হে আল্লাহ, আমার এ গুনাহ মাফ করুন। আমার থেকে ভুল হয়ে গেছে। তখন গুনাহ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। গুনাহও আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি আর আল্লাহ তায়ালা কোনো জিনিস হেকমত ছাড়া সৃষ্টি করেন না। অতএব, গুনাহর সৃষ্টিতেও আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও কৌশল নিহিত আছে এবং তা হলো, গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর যখন তুমি তওবা করবে, অনুতপ্ত ও লজ্জিত হবে, কান্নাকাটি করবে এবং ভবিষ্যতে গুনাহ না করার প্রতিজ্ঞা করবে। তখন এ তওবার কারণে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে নিবেন।

নফসের সঙ্গে সারা জীবন লড়াই কর:

রাতেরবেলা যখন সারাদিনের কাজের মুহাসাবা করার সময় দেখা যাবে যে, আজ গুনাহ হয়ে গেছে তা হলে তৎক্ষণাৎ তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা কর। আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু হও এবং হতাশ হয়ো না। কারণ পুরা জীবনই একটি জিহাদ ও লড়াই; শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত নফস এবং শয়তানের সঙ্গে লড়াই ও যুদ্ধ করতে হয়। আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে এটা ঘটেই থাকে কখনও তুমি পরাস্ত হবে কখনও প্রতিপক্ষ পরাস্ত হবে। সুতরাং শয়তান যদি তোমাকে পরাস্ত করে তখন মনোবল হারিয়ে ফেল না বরং পুনরায় নতুন প্রতিজ্ঞা এবং উদ্দোম নিয়ে দাঁড়িয়ে যাও এবং শয়তানকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়ে যাও। তোমার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা আছে যে, তুমি যদি মনোবল না হারাও বরং পুনরায় মোকাবিলার জন্য দাঁড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। তা হলে ইনশাআল্লাহ! অবশেষে বিজয় তোমারই হবে। আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা হলো,

وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ 

শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য। অতএব তুমিই বিজয়ী হবে। (সূরা: কাসাস, আয়াত: ৮৩)।

তুমি পা বাড়াও, আল্লাহ তোমাকে কোলে তুলে নিবেন।

কোরআন শরিফে অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ .العنكبوت.

যেসব লোক আমার পথে জিহাদ করে অর্থাৎ নফস ও শয়তানের সঙ্গে তুমি এমনভাবে লড়াই করছ যে, শয়তান তোমাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে আর তুমি তার সঙ্গে যুদ্ধ করছ এবং কষ্ট করে ভুল পথ থেকে বেঁচে থাকছ, তা হলে আমার ওয়াদা আছে যে, আমি অবশ্যই অবশ্যই সংগ্রাম ও মেহনতকারীকে আমার পথের দিশা দেব। হজরত থানবি রহ. বলেন, আমি এ আয়াতের তরজমা এভাবে করি যে, যেসব লোক আমার পথে চেষ্টা ও সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে হাত ধরে আমার রাস্তায় নিয়ে আসি।

আল্লাহ তায়ালার সামনে কি এই জবাব দেবে? 

হজরত ডা. আবদুল হাই রহ. বলতেন, মুহাসাবার একটি পদ্ধতি হলো, মনে কর তুমি হাশরের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছ। তোমার হিসাব-কিতাব হচ্ছে। আমলনামা পেশ করা হচ্ছে। তোমার আমলনামায় যেসব বদ আমলের কথা আছে, সেগুলো সামনে পেশ করা হচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালা তোমাকে প্রশ্ন করছেন, তুমি এসব খারাপ কাজ ও গুনাহ কেন করেছ? তখন কি তোমরা আল্লাহকে সেই জবাব দেবে, যা আজকে মৌলবি সাহেবদেরকে দিচ্ছ? আজকে যখন কোনো মৌলবি তোমাকে বলে, অমুক কাজটি কর না, দৃষ্টির হেফাজত কর, সুদ থেকে বেঁচে থাক, গিবত এবং মিথ্যা কথা থেকে বেঁচে থাক, টিভিতে যেসব অশ্লীল ও বাজে প্রোগ্রাম হয় সেগুলো দেখ না, বিবাহ-সাদীর অনুষ্ঠানে পর্দাহীনতা থেকে বেঁচে থাক, এসব কথার জবাবে তোমরা মৌলবি সাহেবকে যে উত্তর দাও, আমরা কি করব, সময়টাই খারাপ, সারা পৃথিবী উন্নতি করছে, চাঁদে চলে গেছে, আমরা কি পেছনে পরে থাকব এবং পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে বসে থাকব? আজকের সমাজে এসব না করে কোনো মানুষই থাকতে পারে না। আজকে মৌলবিদেরকে তোমরা এরূপই জবাব দাও। আল্লাহ তায়ালার সামনেও কি এই জবাব দেবে? এ জবাব কি আল্লাহ তায়ালার সামনে যথেষ্ট হবে? দিলে হাত দিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করে বলো, যদি সেখানে এ জবাব না চলে তা হলে আজকে দুনিয়াতেও এ জবাব যথেষ্ট হবে না।

ঝালকাঠি আজকাল