• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে দুর্নীতিবাজরা বেশি পাওয়ারফুল না

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০১৯  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশব্যাপী চলছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। তিনি আরও নির্দেশনা দিয়েছেন, ঘর (দলের ভেতর) থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে। এরপর যেখানে দুর্নীতি, সেখানেই চলবে অভিযান।

শনিবার (১৯ অক্টোবর) গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের একান্ত আলাপচারিতায় চলমান অভিযান, সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হলো।

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, প্রভাবশালীদের কারণে অনেক সময় দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টি হয়। আপনার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুর্বৃত্তায়ন বাধা পেরিয়ে কতটা এগিয়ে যেতে পারবেন বলে আপনি মনে করছেন?

গণপূর্তমন্ত্রী: অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে শঙ্কাটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটা আনন্দের খবর হলো- বনানীর এফআর টাওয়ারের ৬২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যখন তদন্ত প্রতিবেদন এলো, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ঘটনায় ৩৪ জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেল, তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম। কারণ এদের পক্ষে অনেক তৎবির আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, একজনকেও ছাড় দিবা না। লিগ্যাল অ্যাকশন নাও, যেভাবে দরকার সেভাবে তুমি নাও।

আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে কেউ পাওয়ারফুল না। অতএব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের কেউ বিরত করতে পারেনি। আমরা নদীর পারে অনেক প্রভাবশালীর অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলেছি, আমাদের কেউ ঠেকাতে পারেনি। শিগগিরই আমরা ডেমুলেশন অভিযানে যাব, যেখানে অনেক প্রভাবশালীও রক্ষা পাবে না।

প্রশ্ন: ভবন নির্মাণের সঙ্গে দেশ বির্নিমাণের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক তৈরিতে আপনি কিভাবে কাজ করছেন?

গণপূর্তমন্ত্রী: আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক উন্নত বাংলাদেশ বির্নিমাণ করা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সেটা ছিল ‘সোনার বাংলা’ বির্নিমাণ। খুব অল্প সময়ে বঙ্গব্ন্ধু অনেক বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নতো দূরের কথা, যে ধারণার ওপর বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত দিকে যেতে থাকে দেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এসে ২১ বছর রাস্তায় আন্দোলন করে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিরিয়ে আনেন। বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। যেখানে একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না, বস্ত্রহীন থাকবে না। টাকার অভাবে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হবে না। স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তিনি কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন।

গত নির্বাচনে আমাদের একটা অঙ্গিকার ছিল। সবার জন্য আবাসন, কেউ থাকবে না গৃহহীন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন নগরের সব সুবিধা গ্রামের মানুষকে পৌঁছে দেবো। এই লক্ষ্যে আমার মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

নির্মাণ শব্দটি দুইটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতার জায়গায় নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত নির্মাণ। একটা ধারণা আছে সমস্ত নির্মাণ কাজ গণপূর্ত করে, সব ভবন তাদের এটা ভুল ধারণা। যেমন রেলের নির্মাণ রেল মন্ত্রণালয় করছে, সড়ক-সেতু করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমার মন্ত্রণালয় সে কাজটা করে। আমাদের কাজ শুধুমাত্র টেন্ডার আহ্বান করা। সেই সঙ্গে প্রকৌশলী দেখভাল করেন।

গণপূর্তের একটি অধিদফতর রয়েছে। যেখান থেকে উন্নয়ন কাজ করা হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ২০ তলা ভবন আমরা ১৩ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করেছি। এটা বাংলাদেশে রেকর্ড। এসব ভালো কাজের মধ্যে কিছু খারাপ দিকও দেখা যাচ্ছে। আমাদের কিছু অসাধু প্রকৌশলী এবং অসাধু ঠিকাদার রয়েছে। আমার দফতরে রাজউক’র একটি অংশ রয়েছে। রাজউকের কিছু দুর্বৃত্ত শ্রেণির কর্মচারী-কর্মকর্তারা অতি মুনাফা লোভী মালিক ও ডেভেলপারদের সঙ্গে যোগসাজশে নকশা পরিবর্তন করে ভবন করছেন। যে মানের ভবন নির্মাণ করার কথা, সেটা করছেন না। বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পরে আমরা তদন্ত করে ৬২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।

প্রশ্ন: সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, রাজউক দুর্নীতির আখড়া। এই ধারণায় পরিবর্তন আনতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

গণপূর্তমন্ত্রী: একটি ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য ১৬টি স্তর পার হতে হতো। প্রতিটি টেবিলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সমঝোতাও করতে হতো। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে দেখলাম ১২টি স্তরের কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন কেউ গুলশান এলাকায় ভবন নির্মাণ করবে। সেখানে বিআইডব্লিউটিসি’র অনুমতি লাগবে কেন? আমি ১২টি স্তর বাদ দিলাম। মানুষের হয়রানি কমে গেল। থাকল চারটি দফতর। এই চারটি দফতরে অটোমোশন পদ্ধতি নিয়ে এলাম। ডিজিটাল পদ্ধতি, যে কোনো জায়গা থেকে ল্যাপটপে প্ল্যান সাবমিট করা যাবে। টাকা জমা দিয়ে রশিদ স্ক্যান করে রাজউকে পাঠিয়ে দিলে ম্যাসেজ দিয়ে জানানো হবে ‘আপনার প্ল্যান পাস হয়ে গেছে’। কত দিনে প্ল্যান পাস হবে তার কোনো নির্ধারিত সময় ছিল না। এখন কিন্তু সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ভূমির ছাড়পত্রে সাত দিন, মিউটেশনে সাত দিন এবং প্ল্যান পাসে ৫৩ দিন। এর ভেতরে করতেই হবে।

প্রশ্ন: আধুনিক নগরায়ণের লক্ষ্যে ঢাকা শহর নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

গণপূর্তমন্ত্রী: এক সময় যেখানে-সেখানে হাউজিং গড়ে তোলা হতো। আমি বলছি, এটা এখন আর হবে না। আমাদের তিনটি আধুনিক স্যাটালাইট সিটি হচ্ছে। একটি হলো— নদীর ওপারে ঝিলমিল, একটি উত্তরা থার্ড ফেইস এবং পূর্বাচল আবাসিক এলাকা। এখানে আমরা শতকরা ৫৫ ভাগ জায়গা ফাঁকা রেখেছি। লেক করে দিয়েছি, হাঁটার রাস্তা করেছি, সবুজায়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে। পরিকল্পিত, যেন ইট সুরকির জঞ্জালে পরিণত না হয়।

পুরান ঢাকায় অতি মুনাফা লোভী মালিক, ডেভেলপার আর কিছু দুর্বৃত্তদের কারণে অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। যেমন ১৮তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ২১তলা করা হয়েছে। আবাসিক ভবনের পার্কিং এলাকায় ফাস্ট ফুডের দোকান করা হয়েছে। জরুরি বহির্গমনের জায়গায় ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা এ রকম ১৮শ’ ১৮টি ভবন পেয়েছি। এদের মধ্যে চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ প্রভাবশালীর সংখ্যাই বেশি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি আমরা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারও রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকা। কিন্তু জনবল আছে মাত্র ১৩শ’। এদের মধ্যে কিছু দুর্নীতিবাজ লোকও আছে।

রূপপুরে বালিশকাণ্ডের ঘটনায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমার মনে হয় না, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৯২জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো মন্ত্রণালয় অতীতে ব্যবস্থা নিয়েছে। দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে যা যা করা দরকার— সেটা আমি করছি।

প্রশ্ন: পুরান ঢাকা নিয়ে সরকারের কী ভাবনা রয়েছে?

গণপূর্তমন্ত্রী: পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সরিয়ে নতুন করে একই নকশায় ভবন নির্মাণ করা যায় কি না সেটা আমরা পুরান ঢাকাবাসীর সঙ্গে বসে আলোচনা করবো। ঢাকায় উপচে পড়া ভিড় সরাতে আমরা স্যাটেলাইট টাউন করতে যাাচ্ছি। তিনটি সিটি ছাড়াও তুরাগ নদীর পারে প্রাকৃতিক জলাধর রক্ষা করে শহর হবে, একইভাবে বছিলায় হবে। আর পদ্মার ওপারে নয়ানাভিরাম, স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশসম্মত, আধুনিক, ডিজিটাল অর্থাৎ স্যাটেলাইট সিটি করব। যে সিটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এই পরিকল্পনায় মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন কোম্পানিকে প্রাথমিক সমিক্ষার প্রস্তাব দিয়েছে।

প্রশ্ন: ঢাকায় সবুজায়নে কী পদক্ষেপ নেবেন?

গণপূর্তমন্ত্রী: এই মুহূর্তে ঢাকায় কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। রাস্তার পাশে যেসব জায়গায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে সেগুলো সরিয়ে আমরা গাছ লাগাবো। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সবুজায়ন অবশ্যই দরকার। আর এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও রয়েছে।

প্রশ্ন: জিকে শামীম রাজউকের একজন বড় ঠিকাদার। তার হাতে অনেক প্রকল্প ছিল। সেই প্রকল্পগুলো ভবিষ্যত কী হবে?

গণপূর্তমন্ত্রী: জিকে শামীমের নেওয়া কাজগুলো আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগের। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে শক্ত অবস্থান নিয়েছি যেন কাজের গুণগত মান ঠিক থাকে। এখন যেভাবেই হোক তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে কাজ দেওয়া হয়নি, কাজ দেওয়া হয়েছে তার কোম্পানিকে। কোম্পানি যদি কাজে এগিয়ে না আসে তাহলে শর্ত অনুযায়ী আমি ২৮ দিন অপেক্ষা করব। তারপর আমি আইনানুগ পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন ঠিকার নিয়োগ দেবো। সরকারি কাজ কোনো ব্যক্তির জন্য বসে থাকবে না।

ঝালকাঠি আজকাল