• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

পবিত্র কুরআনে হাইপোক্সিয়া : মিরাকেল না অপব্যাখ্যা?

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারি ২০২০  

 

‘হাইপোক্সিয়া’ (Hypoxia) মেডিকেল সাইন্সের গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্ম। শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘অক্সিজেনের ঘাটতি’। মূলত ফুসফুসে অক্সিজেনের ঘাটতিকে হাইপোক্সিয়া বলা হয়। কেউ কেউ দাবি করছেন যে, কুরআনে এ ব্যাপারে তথ্য রয়েছে। সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বেই কুরআন এ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। এ মর্মে তারা কুরআনের কিছু আয়াতও উপস্থাপন করে থাকেন। আমরা ব্যাপারটি যাচাই করতে চাই এই প্রবন্ধে। 

প্রথমেই আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত জীবনবিধান। হিদায়াতের গ্রন্থ। যদিও কুরআন জ্ঞান-গবেষণাকে, নিত্য-নতুন আবিষ্কারকে উৎসাহিত করে, কিন্তু এটি মৌলিকভাবে বিজ্ঞানের কোনো রেফারেন্স-বুক না। যদিও বিজ্ঞানের মৌলিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত মূলনীতিগুলোর সাথে কুরআনের কোনো সংঘর্ষ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতিটি থিওরি ও শাখা-প্রশাখা কুরআনে থাকতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। প্রথমেই আমাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দরকার যে, আমাদের স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড কী—কুরআন, না বিজ্ঞান? যখন আপনি প্রশ্ন করছেন, ‘এটা কি কুরআনে আছে?’ এর মানে হলো আপনি মানদণ্ড মেনে নিচ্ছেন বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞান যেহেতু বলছে, সুতরাং কুরআনে থাকতে হবে। থাকলেই তবে এটা আল্লাহর বাণী, আর না হয় নয়! কিন্তু যদি আপনার মানদণ্ড হয় কুরআন, তাহলে আপনাকে দেখতে হবে যে, বিজ্ঞানের এই থিওরি কি ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত মূলনীতিসম্মত কি না। যদি ইসলামের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। সেটা কুরআনে থাক বা না থাক। 

এবার আসুন ‘হাইপোক্সিয়া’র ব্যাপারে কথা বলি। কুরআনের কোথাও এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এরপরও কুরআনিক মিরাকেলপন্থি কিছু প্রচারকারী দাবি করছেন যে, কুরআনের ৬ : ১২৫ আয়াতে হাইপোক্সিয়ার ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে। আর তাদের মতে, এটি একটি অলৌকিক ব্যাপার এবং কুরআনের ঐশিত্বের প্রমাণ। আসুন আয়াতটি দেখি, 

فَمَن يُرِدِ اللّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلاَمِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاء كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ

‘আল্লাহ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন, যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে। এমনিভাবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না, আল্লাহ তাদের ওপর আজাব বর্ষণ করেন।’[১] 

প্রথমত, এটি বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো আয়াত নয়, বরং এটি মানুষের মুক্ত ইচ্ছার ক্ষেত্রে আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্পর্কিত একটি আয়াত। আর এটি একটি রূপক আয়াত। এর দ্বারা মানুষের দৈহিক বক্ষ উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো বক্ষস্থিত হৃদয়। এর দ্বারা আল্লাহ বোঝাচ্ছেন, হিদায়াত একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে চান তার জন্য হিদায়াতের পথকে সহজ করে দেন। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, 

يوسع قلبه للتوحيد والإيمان به
‘(এর অর্থ হলো) আল্লাহ তার হৃদয়কে তাওহিদ ও ঈমানের জন্য উপযুক্ত করে দেন।’[২]

সাহাবাগণ এ আয়াত সম্পর্কে নবিজিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘একধরনের আলো তার হৃদয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। ফলে তার হৃদয় ইসলাম গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।’ সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, ‘হৃদয় প্রশস্ত হওয়ার কি কোনো আলামত আছে, যা দেখে ব্যাপারটা বোঝা যাবে?’ নবিজি (সা.) বললেন, ‘(এর আলামত হলো) চিরস্থায়ী জীবনের দিকে মনোনিবেশ করা, প্রতারণাপূর্ণ ইহজগত থেকে পলায়নপর হওয়া এবং মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।’[৩]

আয়াতের দ্বিতীয়াংশই হলো, ‘তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন, যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে।’ এ অংশটুকুই তাদের মূল দলিল। অথচ পাঠক যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করেন যে, আয়াতের প্রথমাংশে যা বলা হয়েছে, দ্বিতীয়াংশও ঠিক তার অনুরূপ। অর্থাৎ এখানেও ‘বক্ষ’ শব্দটি রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ যে কুফরির পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার বক্ষস্থিত হৃদয়কে সংকীর্ণ করে দেন। হিদায়াতের পথকে তার জন্য কঠিন করে দেন। 

এক বেদুইন সাহাবি উমর ইবনুল খাত্তাবকে এই আয়াতে বর্ণিত ‘হারজ’ তথা ‘সংকীর্ণতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘তা হলো এমন গাছ, যার দ্বারা রাখাল, জন্তু-জানোয়ার অথবা কোনকিছুই উপকৃত হয় না। মুনাফিকদের হৃদয় হলো এমনই গাছের মতো, যার কোনো উপকারিতা নেই।’ 

ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তার জন্য ইসলামকে কঠিন করে দেন। অথচ ইসলাম সহজ।’ 

ইমাম আওযায়ি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কী করে তার পক্ষে মুসলিম হওয়া সম্ভব, যার হৃদয়কে আল্লাহ সংকীর্ণ করে দিয়েছেন?’

‘যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে’ এটাও রূপক। এ ব্যাপারে সাহাবি ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘(এর অর্থ হলো) কোনো মানুষের পক্ষে যেমন আকাশে পৌঁছা সম্ভব না, কারও হৃদয়ে তাওহিদ এবং ঈমান প্রবেশ করাও সম্ভব না, যদি না আল্লাহ তার হদয়ে তা প্রবেশ করান।’[৪]

হাইপোক্সিয়ার সাথে আবশ্যিকভাবে সম্পৃক্ত ব্যাপারগুলো হলো অক্সিজেন, লেক অব অক্সিজেন, ফুসফুস। কিন্তু এরকম কোনো ব্যাপারই উপরোক্ত আয়াতে নেই। সুতরাং এ আয়াত দিয়ে ‘হাইপোক্সিয়া’ বা লেক অব অক্সিজেন প্রমাণ করতে যাওয়া কুরআন ও কুরআন ব্যাখ্যার মূলনীতি বিরোধী। 

বিজ্ঞানের কল্পকথা

কুরআনিক মিরাকেলপন্থিরা এই দাবিতে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সরবরাহ করেনি যে, কতটুকু উচ্চতায় পৌঁছালে বক্ষ সংকোচন হয়। ফুসফুস বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সংকোচনের ব্যাপারটাকেই তারা বক্ষ সংকোচন ধরে নিয়েছে। এরপর কুরআনের রূপক আয়াতগুলোকে বাহ্যিক অর্থে প্রয়োগ করেছে। এতদসত্ত্বেও যদি আমরা ধরে নিই যে, উপরোক্ত আয়াতের শাব্দিক অর্থই এখানে উদ্দেশ্য, তারপরও প্রশ্ন আসে যে আয়াতে তো কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যারা তাওহিদে ঈমান আনার জন্য চেষ্টা চালায় না, আল্লাহ তাদের বক্ষকে সংকোচন করে দেন। তাহলে এটা তাদের দাবি মতে, কাফিরদের ক্ষেত্রে ঘটে, বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে নয়। আর তারা এমন কোনো প্রমাণও পেশ করতে পারেনি যে, কাফিরদের চেয়ে মুমিনদের ফুসফুস এতটাই শক্তিশালী যে, মহাকাশে তাদের ‘হাইপোক্সিয়া’ বা লেক অব অক্সিজেন হয় না, বক্ষ সংকোচন হয় না—তাহলে পুরো ব্যাপারটা অলৌকিকতার পরিবর্তে হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে।

আরেকটা গুরুতর ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের সবকিছুকে কুরআন দিয়ে প্রমাণ করাটা বর্তমানে একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। সমস্যাটা হলো, বিজ্ঞান যেহেতু স্থির কোনো ব্যাপার না, বরং নিত্য পরিবর্তনশীল, আর কুরআন অপরিবর্তনীয়, চিরন্তন; তো ধরুন কেউ বিজ্ঞানের কোনো থিওরিকে কুরআন দিয়ে টেনেটুনে প্রমাণ করে দিল। কিন্তু কদিন পর দেখা গেল বিজ্ঞানের সেই থিওরিটি ভুল, তখন কি (নাউযুবিল্লাহ) কুরআনকেও ভুল বলা হবে না? এজন্য আগে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড নির্ধারণ করা উচিত— নিত্য পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান, না অপরিবর্তনীয়, চিরন্তন কুরআন?

মোটকথা হাইপোক্সিয়া বা মহাশূন্যে লেক অব অক্সিজেন তত্ত্ব যদিও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, কিন্তু কুরআনের উপরোক্ত আয়াত মোটেই তা প্রমাণ করে না। আর সেটা জরুরিও না, যা আমরা আগেও আলোচনা করেছি। কুরআন হিদায়াতের গ্রন্থ, জীবনবিধান, আইনি কিতাব। এখানে বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখার আলোচনা থাকা জরুরি না। জরুরি হলো, এত্থেকে জীবনচলার পথে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা। সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

তথ্যসূত্র
১. সুরা আনয়াম, ৬ : ১২৫
২. ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ৬ : ১২৫ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য।
৩. তাবারি, জামিয়ুল বায়ান, ৬ : ১২৫ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য।
৪. ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ৬ : ১২৫ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য।

ঝালকাঠি আজকাল