• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

গর্ভবতী মায়েদের কিছু বিপদচিহ্ন

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০১৯  

গর্ভকালীন সময় অর্থাৎ গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে প্রসবকালীন সময় পর্যন্ত প্রতিটা গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এসময় সামান্য একটু অসচেতনতা বা একটু  অবহেলা মা ও তার অনাগত সন্তানের ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এসময় প্রতিটা ব্যাপার বা যে কোণো সমস্যা হলে তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। এমন কিছু উপসর্গ আছে যা কোনো অবস্থাতেই অবহেলা করা যাবে না। সেইসব উপসর্গগুলো দেখার সাথে সাথে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ সহ নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া উচিত। 

আসুন জেনে নিই গর্ভবতী মায়ের  এমন ১০ টি বিপদ চিহ্ন যা দেখলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন বিপদ সংকেত

গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মায়ের কিছু উপসর্গ যেগুলোর যে কোনোটা দেখা যাওয়া মানেই বিপদের শঙ্কা। এই উপসর্গগুলোর সামান্য উপস্থিতিও টের পেলে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করা উচিত।

নিচে এমন কিছু বিপদশংকুল উপসর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।  

১। দীর্ঘসময়  পেট ব্যাথা: 

গর্ভবতীর পেটের উপরিভাগ বা মাঝ বরাবর যদি অসহনীয় ও খিঁচুনির মতো ব্যথা এবং সাথে যদি বমি হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। বদহজম কিংবা পেটের কোনো সমস্যা বা খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত কারণেও পেটে ব্যথা হতে পারে। তলপেটের এক পাশে বা উভয় পাশেই প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, যেমন, কোনো লিগামেন্ট-এ টান পড়া। আরও অন্যান্য সমস্যার কারণে পেটে ব্যাথা হতে পারে, যেমন জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ, গর্ভপাত,অপরিনত প্রসব যন্ত্রণা, কোনো ফাইব্রয়েড-এর বিকাশ ও রক্তক্ষরণ, গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

তবে বেশিরভাগ নারীই গর্ভকালীন সময়ে এরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। তবে এটা যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে তবে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

২।গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গায়ে তীব্র চুলকানি: 

যকৃতের কোনো জটিলতার Obstetric Cholestasis (OC) জন্য গর্ভাবস্থার শেষের দিকে সারা গায়ে চুলকানি হতে পারে । এ অবস্থা জন্ডিসের কারণেও হতে পারে। বাচ্চার বিকাশের সাথে সাথে গর্ভবতীর ত্বকও বিস্তৃত হয় তাই কিছু কিছু চুলকানির ভাব হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু  যদি পায়ের পাতার নিচের অংশে আর হাতের তালুতে তীব্র চুলকানি হয় আর সেটা রাতের বেলা আরও বেড়ে যায় তাহলে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। 

৩। জ্বর হওয়া: 

গর্ভবতীর শরীরে কোনো সর্দি বা ঠাণ্ডা লাগার উপর্সগ না থাকা সত্ত্বেও শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে উঠে গেলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত। আর যদি তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায় তাহলে সাথে সাথে ডাক্তার ডাকা উচিত। কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য শরীরের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে থাকলে তা গর্ভস্থ শিশুর জন্য অনেক ক্ষতিকর হতে পারে। সাধারণত কোনো ধরণের জীবাণু সংক্রমণের জন্য এমন হতে পারে। তাই এমন হলে ডাক্তার হয়তো রোগীকে  প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক খেতে ও বিশ্রাম নিতে বলতে পারেন।

৪। হাল্কা বা ভারী রক্তস্রাব

গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে যখন জরায়ুর গায়ে ভ্রুণ প্রোতিথ হয়, তখন হাল্কা রক্তস্রাব হওয়া স্বাভাবিক। তবে গর্ভাবস্থায় যে কোনো সময় রক্তস্রাব হলেই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেয়া ভালো, কারণ এটা হয়তো অনেক বড় জটিলতারও উপসর্গ হতে পারে। যদি স্বাভাবিক মাসিক স্রাব থেকে এই রক্তস্রাব আলাদা হয় অর্থাৎ হাল্কা, ভারী বা বেশি গাঢ় এবং সেই সাথে পেটের একপাশে ক্রমাগত অসহনীয় ব্যথা হয় তাহলে এটা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ হবার লক্ষণ (Ectopic Pregnancy)।  পিঠে বা পেটে একটানা ব্যথার সাথে সাথে ভারী রক্তস্রাব হলে গর্ভপাতের আশংকা থাকে। গর্ভফুল নেমে যাওয়া বা জরায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গর্ভাবস্থার শেষের দিকে রক্তস্রাব হওয়ার প্রধান কারণ। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই (৩৭ সপ্তাহ হবার আগেই) প্রসব যন্ত্রণা তৈরি করতে পারে। তাই অবহেলা না করে এসব লক্ষণ দেখা মাত্রই অতিসত্বর রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

৫। হাত-পা ফুলে যাওয়া: 

গর্ভাস্থায় হাত, পা বা চোখ ফুলে যাওয়া (oedema) খুব স্বাভাবিক ঘটনা হলেও যদি এটা হঠাৎ করে তীব্র মাত্রায় হয় এবং সাথে মাথা ব্যথা থাকে ও দেখতে সমস্যা হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এটা প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ তাই বিষয়টি মোটেই অবহেলা করা উচিত নয়।  

৬। মাথাব্যথা বা চোখে ঝাপসা দেখা :

গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পরে এ সমস্যা দেখা দেয়। এসময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায় ও প্রস্রাবের সাথে দেহ থেকে প্রোটিন চলে যেতে থাকে। এর কম হলে আরো ধরে নিতে হবে যে, কিডনি ঠিকভাবে কাজ করছে না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা না হলে এ সমস্যাটি ইক্যামপ্লিসিয়ানামে জটিল সমস্যায় রুপান্তরিত হতে পারে। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট এটাক হতে পারে। তাছাড়া  দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অস্পষ্ট বা ঝাপসা দেখাসহ সবকিছু জোড়া জোড়া দেখলে সাথে সাথে চিকিৎসকের স্বরনাপন্য হওয়া উচিত। আর যদি চোখে ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানির মতো লাগে তবে তা শীঘ্রই ডাক্তারকে জানাতে হবে কারণ এসব প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ। তাই গর্ভাবস্থায় চোখের সমস্যা কখনই অগ্রাহ্য করা যাবেনা।

৭। যোনি থেকে হঠাৎ করে পানি নির্গত হওয়া :

গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হয়ে যাওয়া মূত্রথলির উপ চাপ পড়ে। তাই প্রস্রাব করার সময় খেয়াল রাখতে হবে অতিরিক্ত প্রস্রাব হচ্ছে কিনা। ধরুন, আপনি পানি পান করলেন ও হুট করেই দেখলেন প্রস্রাবের স্থানটি ভিজে গিয়েছে, তাহলে আপনাকে সতর্ক হতে হবে। এরকম হওয়ার একটা বিপজ্জনক কারণ হচ্ছে, গর্ভস্থ সন্তান যে আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে মায়ের গর্ভে, সেটা ফেটে গেছে। এর ফলে গর্ভস্থ সন্তান বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এরকম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন যিনি বুঝতে পারবেন যে যোনি বা প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে নির্গত পানি কারণ কি।

৮। প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া

প্রস্রাবের সময় যদি প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া সহ জ্বর জ্বর ভাব, কাঁপুনি আর পিঠে ব্যাথা থাকে তাহলে বুঝতে হবে রোগীর ইউরিনারি ট্র্যাক্ট বা মুত্রনালিতে ইনফেকশন রয়েছে। তাই প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া করলে নিকটস্থ অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা লাগতে পারে।  

৯। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি হওয়া

গর্ভাবস্থায় দিনে দুইবারের বেশি বমি হলে রোগী পানিশূন্য ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাই একটানা ও অতিরিক্ত পরিমাণ বমি হলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালেও ভর্তি করা লাগতে পারে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে পাঁজরের নিচে প্রচণ্ড ব্যাথার সাথে সাথে যদি বমি হলে তা প্রি-এক্লেম্পশিয়ার লক্ষণ। এছাড়া বমির সাথে সাথে পেটে ব্যথা ও উচ্চ তাপমাত্রা থাকলে তা কোনো ইনফেকশনের কারণেও হতে পারে। তাই যেটাই হোক না কেন গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি হলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

১০। বাচ্চার নড়া-চড়া কমে যাওয়া:

শিশু যখন মায়ের জরায়ুতে থাকে তখন ঘুমিয়ে থাকে- এটা সাধারণভাবে আমরা জানি। কিন্তু গর্ভস্থ সন্তান যদি হুট করে সব ধরণের নড়াচড়া বন্ধ করে দেয় তবে তা অবশ্যই বিপদের লক্ষণ।   গর্ভের ২১ সপ্তাহের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি র গর্ভস্থ শিশুর নড়াচড়া কমে যায় বা একদমই না হয় তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার কোনো সমস্যা হয়েছে।

American Congress of Gynaecologists and Obstetricians (ACOG) এ ব্যপারে একটি পরামর্শ দিয়েছে। গর্ভস্থ সন্তান মায়ের পেটে থাকতেই হাত বা পা ছোঁড়াছুড়ি করে। ফলে মায়ের পেটের ভেতরের দিকে তার পায়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। আমাদের এটা বের করতে হবে যে, প্রতি ১০ বার পা দিয়ে মায়ের পেট স্পর্শ করতে বা কিক দিতে শিশুটির কতক্ষণ সময় লাগছে। যদি এ সংখ্যাটি কমে যায় কিংবা ১০ টি কিক সম্পন্ন করতে গর্ভস্থ সন্তানের ২ ঘন্টার বেশি সময় লাগে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

 

 একজন মায়ের দীর্ঘ নয়মাসে গর্ভধারণের কষ্টগুলো একরাশ আনন্দে পরিণত হয় তার ছোট্ট সোনামণি হাসিমুখ দেখার পর।আর একজন নারী পরিপূর্ণ নারী হয় মা হবার পর। তাই গর্ভধারনের সময়ে ঝুঁকিপুর্ণ লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই গুরুত্বপুর্ণ। তাই এসময় গর্ভবতী  নিজেকে এবং গর্ভের শিশুকে নিরাপদ রাখার জন্য অধিক সচেতন হতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মূখ্য ভুমিকা পালন করতে হবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে ও এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে ও গর্ভবতী মাকে প্রয়োজনীয়  সহযোগিতা করতে হবে।

ঝালকাঠি আজকাল