• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

ঝালকাঠি আজকাল

ফেরিঘাটে মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো লাগবে না

ঝালকাঠি আজকাল

প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২২  

অ্যাম্বুলেন্সচালক সহিদুল ইসলাম সহিদ। যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ শহরের আশেপাশে গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক থেকে সংকটাপন্ন বহু রোগীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়েছেন। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে আটকে থেকে রোগী মৃত্যুও প্রত্যক্ষ করেন তিনি। তার মতো অনেকেই ফেরিঘাটে রোগীর মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো। পদ্মা সেতু চালু হলে এ রকম স্মৃতি হয়তো আর কাউকে তাড়া করবে না। পদ্মাসেতু চালুর খবরে যশোর অঞ্চলে এ ঘাট ব্যবহারকারী শতাধিক অ্যাম্বুলেন্সচালক ও তাদের যাত্রীর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে সময়মতো ফেরি না পাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন হাজারো মানুষ। নারী-শিশু ও রোগীদের নিয়ে পড়তে হয় চরম বিপাকে। বেশি বিপাকে পড়ে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পালা শেষে যখন ফেরিতে ওঠে অ্যাম্বুলেন্স, তখন প্রায়ই মাঝনদীতে রোগীর মৃত্যু ঘটে। চারিদিকে অন্ধকার আর থৈ থৈ পানির শব্দের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কান্নার আওয়াজ প্রমত্তা পদ্মার হৃদয়কেও যেন নাড়িয়ে দেয়। এই সংকটের অবসান হতে যাচ্ছে শনিবার (২৫ জুন)। এদিন উন্মুক্ত হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পরদিন ভোর থেকে চলবে যানবাহন। ঘাটসহ ফেরি পারাপারে দুই ঘণ্টার পথ শেষ হবে ১০ মিনিটে। তবে চালকদের দাবি, টোল একটু বেশি, এটি কমানো প্রয়োজন। তা না হলে আর্থিকভাবে সেতুর উপকারিতা স্বজনরা পাবে না।

মাঝ বয়সী অ্যাম্বুলেন্সচালক সহিদুল ইসলাম সহিদ। বাড়ি যশোর শহরেই। রোববার বিকেলে যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দেয়ার অপেক্ষা করছিলেন। হাসপাতালের ভেতর থেকে রোগীর স্বজনরা জরুরি বিভাগের সামনে আসলেই তাদের উদ্দেশ্য করে বলছিলেন ‘কি ভাই/আপা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে নাকি? না নিলে অন্য আরেক ব্যক্তিদের দিকে চিরচেনা রীতিতে ডাকছেন রোগীদের স্বজনদের’। পদ্মাসেতু চালু হলে কি উপকার পাবেন জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের চেয়ে রোগী-স্বজনরা বেশি উপকৃত হবেন। খুব দ্রুত সময়ে ঢাকার যেকোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ব্রেনস্ট্রোক করা মাঝ বয়সী এক ব্যক্তিরে কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সারাপথ দ্রুত গেলেও ফেরিঘাটে ফেরির রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগী নিয়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীদের রেখে ফেরির টিকিট কাটতে যেয়ে এসে দেখি রোগীদের কান্নার আহাজারি। মারা যান স্ট্রোক করা সেই ব্যক্তি। বাঁচা-মরা আল্লাহর কাছে তার পরেও যদি সেতু থাকতো তা হলে দুই ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা না করলে হয়তো তাকে ঢাকাতে নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতাম। বেঁচেও যেতেন ওই রোগী। এখন পদ্মাসেতু হয়েছে; আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করা লাগবে না। ফেরিতে যাতায়াতের কারণে দ্রুতই যশোর অঞ্চলের মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাবে ঢাকা শহরে।

যশোর থেকে প্রায় রোগী নিয়ে ঢাকায় যান অ্যাম্বুলেন্সের চালক এখলাসুর। তিনি বলেন, ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। এতে নিজের এবং রোগীর অনেক ভোগান্তি হতো। রোগীর অবস্থা অনেক সময় আরও অবনতির দিকে যেত। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যেত। তবে এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এসব সমস্যার অবসান ঘটবে। চোখের সামনে ফেরিতে অ্যাম্বুলেন্সে অনেক মানুষের আহাজারি দেখেছি। মাঝ নদীতে করার কিছু ছিল না। আজ পদ্মা নদীতে সেতু হয়েছে। ভালো লাগছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে শুধু যশোরবাসী না এই অঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসা-যাওয়ায় ফেরি পারাপারে সীমাহীন ভোগান্তির অবসান হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন ২৫ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্সচালক এখলাসুর।

এদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে সময়মতো ফেরি না পাওয়ায় দুর্ভোগে পড়ে কতজনেরই তার চোখের সামনে ফেরিঘাটে বা ফেরিতে স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে। তেমনি এক স্বজন যশোরের মণিরামপুরের রোহিতার শেখ পাড়ার সালমান শেখ। তার বাবা সুলাইমান শেখ গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বাবাকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে তার বাবা মারা যান। সেই দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত হওয়ায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকায় তার এক চিকিৎসক স্বজনের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তাই দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে ভাড়া করা হয় অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ১২টার দিকে। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষার পর রাত ২টার পরে ছাড়া হয় ফেরি। বিলম্বে আসার কারণে রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসায় তাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর কিছুক্ষণ পর মারা যান তার বাবা। তার দাবি, নির্ধারিত সময় ফেরি ছাড়লে যথাসময় চিকিৎসা করানো যেত, তাতে হয়তো ঠেকানো যেত তার বাবার করুণ পরিণতি। এবার যশোর অঞ্চলের মানুষ খুব সহজেই ঢাকায় যেতে পারবে। সেখানে দ্রুত যেয়ে উন্নত চিকিৎসা পাবে। পদ্মা সেতু চালুর খবরে সাধারণ মানুষের মতো খুশি যশোর অঞ্চলের চিকিৎসকেরাও। যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, পদ্মাসেতু চালু হলে যশোরের অঞ্চলের স্বজনেরা দ্রুত রোগীদের ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। দ্রুত যাওয়ার ফলে উন্নত চিকিৎসা পাবে। তবে নড়াইলের কালনা সেতু হওয়ার পর সড়কপথে পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাবে এই অঞ্চলের মানুষ, এমনটাই মনে করেন এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

ঝালকাঠি আজকাল